গর্ভপাতের কারণ: কোন মা সন্তান ধারণ করার প্রথম 24 সপ্তাহ বা সাড়ে পাঁচ মাসের মধ্যে যদি তার শিশু গর্ভেই মারা যায়, তাহলে তাকে বলা হয় মিসক্যারেজ বা গর্ভপাত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, প্রতি 100 জন গর্ভবতী নারীর মধ্যে 10 থেকে 15 শতাংশের ক্ষেত্রে গর্ভপাত এর ঘটনা ঘটে। এর ফলে একজন মাকে যেমন নানা শারীরিক জটিলতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়, তেমনি এর মানুষের যন্ত্রণা ও কোন অংশে কম নয়। গর্ভপাত কেন হয়? এটি প্রতিরোধে একজন মায়ের করনীয় কি? সে বিষয়ে আজকে আমরা আপনাদের বিস্তারিত জানাবো।
গর্ভপাতের কারণঃ
গর্ভপাতের ঘটনায় অনেক সময়ই মায়ের দিকে আঙুল তোলা হয়,যে নিশ্চয়ই তিনি কিছু করেছেন বা করা দরকার ছিল এমন কিছু করেন নি, যার কারণে এমনটা হয়েছে। এ ব্যাপারে বৃটেনের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ পরিষ্কার জানিয়েছে যে, গর্ভপাতের পেছনে মূলত এমন সব কারণ দায়ী যার পেছনে মায়ের কোনো হাত নেই। মায়ের বয়স যদি 35 বছরের বেশি তাহলে তার গর্ভপাতের ঝুঁকি কম বয়সী নারীদের চাইতে বেড়ে যায়। ব্রিটেনে জাতীয় স্বাস্থ্য সেবা সংস্থার তথ্য বলছে, 35 বছর বয়সে গর্ভপাতের ঝুঁকি 20% থাকে। 40 বছর বয়সের ঝুঁকি বেড়ে 33 থেকে 40 শতাংশে দাঁড়ায়। 45 বছর বয়সে হাড় 57 থেকে 80 শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে।
ক্রোমোজোম সংক্রান্ত সমস্যাঃ

গর্ভপাত হওয়ার বড় কারণ মায়ের গর্ভে অনাগত শিশুটির সঠিক বিকাশ না হওয়া। ক্রোমোজোমের সংখ্যা বেশি বা কম হলে অর্থাৎ গর্ভধারণের সময় ভ্রুনে ক্রোমোজোমের সুষম পরিমাণ না থাকলে গর্ভপাত হতে পারে। ক্রোমোজোম হলো প্রতিটি কোষের ভেতরে সুতার মত এক ধরনের স্ট্রাকচার যা প্রাণীর জেনেটিক তথ্য বহন করে। শিশুটি দেখতে কেমন হবে? তার মেধা কেমন হবে? এক কথায় তার বিকাশের সব তথ্যই ঐ ক্রোমোজোমের মধ্যে থাকে।
গ্লোবাল হেপেন খবর পেতে ফলো করুন আমাদের গুগল নিউজ চ্যানেল
যখন ডিম্বাণু ও শুক্রাণু একত্রিত হয়, তখন মা ও বাবার থেকে একটি একটি করে মোট দুটি ক্রোমোজোমের সেট তৈরি হয়। কখনো কখনো গর্ভধারণের সময় মা-বাবার কাছ থেকে কম অথবা বেশি ক্রোমোজোম চলে আসতে পারে। এর ফলে গর্ভের শিশুর দেহে ক্রোমোজোম সংখ্যা কম বেশি হয়। এটি শিশুর স্বাভাবিক বেড়ে ওঠার পথে বাধা সৃষ্টি করে। পরিণতি স্বরূপ মায়ের গর্ভপাত হতে পারে। ক্রোমোজোম কম বেশি হওয়া মানে শিশু ভূমিষ্ঠ হলেও নানা অস্বাভাবিকতা নিয়ে জন্মগ্রহণ করত।
জরায়ু ও গর্ভফুলে সমস্যাঃ
মায়ের জরায়ু মুখ অর্থাৎ সার্ভিক্স এবং সার্ভিকাল টিস্যু যদি দুর্বল হয়, সেই সাথে জরায়ুর আকৃতি অস্বাভাবিক থাকে, জরায়ু ছোট হলে কিংবা জরায়ুতে ফাইব্রয়েড থাকলে গর্ভপাতের ঝুঁকি বেড়ে যায়।এরি এমন একটি অঙ্গ যা গর্ভাবস্থায় জরায়ুতে বিকাশ লাভ করে এবং জরায়ুর প্রাচীর এর সাথে সংযুক্ত থাকে। গর্ভের শিশু এ প্লাসেন্টা থেকে অক্সিজেন ও পুষ্টি পায়। শিশুর রক্ত থেকে বর্জ্য পদার্থ বের করে দেয় এই প্লাসেন্টা। কখনো কখনো প্লাসেন্টা রক্তনালীগুলো সমস্যা দেখা দিলে বা প্লাসেন্টা পুরোপুরি বিকশিত না হলে গর্ভপাত হতে পারে।
হরমোনজনিত সমস্যাঃ
মায়ের হরমোনজনিত সমস্যা বিশেষ করে পলিসিসটিক ওভারি সিন্ড্রোম, পিসিওএস থাকলে হরমোনের পরিবর্তনের ফলে ডিম্বাশয় স্বাভাবিকের চেয়ে বড় হয়। ডিমের উৎপাদন কমে যায়, মাসিক অনিয়মিত হয়ে পড়ে সে ক্ষেত্রে তাদের জন্য গর্ভধারণ যেমন কঠিন তেমনি একবার গর্ভধারণ করলে সেটি গর্ভপাত হওয়ার ঝুঁকিও বেশি থাকে।
মায়ের শারীরিক পরিস্থিতিঃ
মায়ের যদি রুবেলা হয় এবং তীব্র জ্বর এবং সেইসাথে অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ কিডনি-জটিলতা, স্থূলতা,কম ওজন বা থাইরয়েডের সমস্যা থাকে, তাহলে গর্ভপাতের ঝুঁকি বাড়ে। এছাড়াও ম্যালেরিয়া, গনোরিয়া, সিফিলিস, এইচআইভি বা যৌন সংক্রমণ জনিত বিভিন্ন রোগ থাকলে গর্ভপাতের ঝুঁকি বাড়ে।
অতীতে গর্ভপাত হলেঃ
যদি অতীতে মায়ের এক বা একাধিক গর্ভপাতের ইতিহাস থাকে তাহলে তার পরবর্তীতেও গর্ভপাতের ঝুঁকি বেশি। তবে চিকিৎসকরা এটাও বলেছেন যে, একাধিক গর্ভপাতের পর অনেকের পরবর্তীতে সুস্থ শিশু জন্ম দেয়ার নজির আছে।
প্রচন্ড চাপঃ
মা যদি অতিরিক্ত কাজের চাপে থাকে, বার বার উঠবস করতে হয়, ক্ষতিকর রাসায়নিক ও বিকিরণ এর মাঝে কাজ করা লাগে, পেটে বারবার ঝাঁকুনি লাগে কিংবা পড়ে গিয়ে পেটে জোরে চাপ লাগে, সে ক্ষেত্রেও গর্ভপাত হতে পারে।
অন্যান্যঃ
যেসব মায়ের ধূমপান, মাদক সেবন, এমনকি মাত্রাতিরিক্ত কফি খাওয়ার নেশা থাকে তাদের গর্ভপাতের ঝুঁকি এসব গ্রহণ না করা মেয়েদের তুলনায় বেশি। আটরাইস্টিসের এর ঔষধ একজিমা বা ব্রণের চিকিৎসা দেয়া হয় এবং পেইনকিলার জাতীয় ঔষধ খাওয়ার আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। মা বোন বা ঘনিষ্ঠজনদের মিসক্যারেজের জিনগত ইতিহাস থাকলে সেই ঝুঁকি পরবর্তী প্রজন্মের ওপর বর্তাতে পারে।
গর্ভপাত সম্পর্কে ভুল ধারণা ও প্রতিরোধঃ
গর্ভবতী মায়েদের নিয়ে বেশ কিছু ভুল ধারনা আছে। যেমন চাপ বা বিষণ্ণতায় থাকলে গর্ভাবস্থায় কোন ঘটনায় অনেক ভয় পেলে বা চমকে গেলে গর্ভপাতের ঝুঁকি বাড়ে।যা একদম ভুল ধারণা। আবার এমন ধারণাও আছে যে গর্ভবতী মাকে সম্পূর্ণ বিশ্রামে থাকতে হবে। স্বাভাবিক কাজকর্ম করলেই বিপদ। চিকিৎসকরা গর্ভকালীন মায়েদের হালকা ব্যায়াম করার পরামর্শ দেন এবং স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে বলেন। অনেকেই ভাবেন গর্ভাবস্থায় কোন অবস্থাতেই সহবাস করা যাবে না। বিমানে ভ্রমণ করা যাবেনা, মসলাদার খাবার বা নির্দিষ্ট কয়েক ধরনের খাবার খাওয়া যাবেনা। কিন্তু এগুলো সবই ভুল ধারণা।।
গর্ভধারণের আগে জন্ম নিরোধক ঔষধ খেলে পরে কোন সমস্যা হয়না। গর্ভকালীন পরিস্থিতি নজরে রাখতে নিয়মিত চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থাকা জরুরি। এসময় চিকিৎসকরা বিভিন্ন ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট খেতে বলেন, যা মেনে চলা জরুরী। তবে যেসব মায়েদের ধূমপান মদ্যপান এবং মাদক সেবনের অভ্যাস আছে তাদের অবশ্যই সেগুলো ছাড়তে হবে। সেইসাথে সুষম খাদ্যাভ্যাস এবং সংক্রামক রোগ এড়িয়ে চলতে পারলে মা ও শিশু অনেকটাই সুস্থ থাকবেন।
লক্ষণঃ
গর্ভপাতের প্রধান লক্ষণ হলো যোনিপথ দিয়ে রক্তপাত। ঐ রক্ত উজ্জ্বল লাল বা জমাট বাধা হতে পারে। তবে একটি বিষয় মনে রাখবেন যে, গর্ভাবস্থায় প্রথম তিন মাসে যোনিপথে হালকা রক্তপাত হওয়া স্বাভাবিক বিষয়। এর মানে এই নয় যে আপনার গর্ভপাত হয়েছে। যোনি থেকে তরল বাদামি স্রাব, টিস্যুর স্রাব যেতে পারে।তলপেটে তীব্র ব্যথা গর্ভপাতের আরেকটি বড় লক্ষণ। তবে অনেকের ক্ষেত্রে এই ব্যথা নাও হতে পারে। পেলভিক এলাকায় বা পিঠের নিচের অংশে ব্যথা অনুভূত হতে পারে। গর্ভপাতের 2/1 দিন পর অনেকের জ্বর এবং ইউরিন ইনফেকশন হয়। সেই সাথে ভীষন দুর্বলতা, মাথা ঘোরা, রক্তচাপ কমে যাওয়া, রক্তস্বল্পতা, ডায়রিয়া বমি মাথাব্যথা থাকতে পারে। এ ধরনের লক্ষণ দেখা দেয়ার সাথে সাথে এক মুহূর্ত দেরি না করে গর্ভবতী মাকে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
চিকিৎসাঃ
স্বাস্থ্য পরীক্ষায় চিকিৎসক যখন নিশ্চিত হন যে, গর্ভপাতের ঘটনা ঘটেছে তখন তারা মূলত তিনটি উপায়ে চিকিৎসা করে থাকেন। প্রথমত স্বাভাবিকভাবে কোন ঔষধ ছাড়াই রোগের রক্তপাত চলতে দেন যেন স্বাভাবিক গতিতেই গর্ভপাত সম্পন্ন হয়। সাধারণত দুই সপ্তাহের মধ্যেই স্বাভাবিক গর্ভপাত সম্পন্ন হয়। রক্তপাত বন্ধ হওয়া মানে গর্ভপাত সম্পন্ন হয়েছে। রোগের পরিস্থিতি বুঝে চিকিৎসক ওষুধ দিয়ে গর্ভপাত ঘটাতে পারেন। ওষুধটি যোনিপথের ভেতর দিয়ে প্রয়োগ করা হয় যেন সার্ভিক্স খুলে যায়। এভাবে দুই থেকে তিন সপ্তাহ রক্তপাত এর মাধ্যমে গর্ভপাত সম্পন্ন হয়।
আবার পরিস্থিতি জটিল হলে চিকিৎসকরা অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে গর্ভাশয় পরিষ্কার করে ফেলেন। গর্ভপাত সম্পন্ন হয়েছে কিনা সেটা চিকিৎসক স্বাস্থ্য পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত করবেন। যদি তিন সপ্তাহের পর ও রক্তপাত বন্ধ না হয়, রক্তপাত যদি ভারী হয়, অপ্রীতিকর গন্ধযুক্ত স্রাব যায়, পেটে অনেক ব্যথা হয়, কিংবা রক্তপাত বন্ধ হওয়ার পর প্রেগনেন্সি টেস্টে ফলাফল পজিটিভ দেখায়, তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। গর্ভধারণের 8 থেকে 10 সপ্তাহ পর্যন্ত গর্ভপাত করা হলে মায়ের ঝুঁকি অনেক কম থাকে সময়ের সাথে সাথে ঝুঁকি বাড়ে।
গর্ভপাতের পরঃ
মিসক্যারেজ বা গর্ভপাত করা হলেও এর পরবর্তী সময়ে নারীদের পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠতে এক থেকে দুই মাস সময় লাগে। কিন্তু অনেকেই মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন, অপরাধবোধে ভোগার হঠাৎ হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে যান। সঠিক সময়ে এর চিকিৎসা করা না হলে এই মায়েরা দীর্ঘস্থায়ী বিষণ্ণতার শিকার হতে পারেন। তাকে বোঝাতে হবে গর্ভপাত হওয়া মানে এই নয় যে, আপনি কখনো গর্ভধারণ করতে পারবেন না। বরং সুস্থ হওয়ার পর চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে পুনরায় সন্তান নেয়ার চেষ্টা করতে পারবেন।
সাধারণত গর্ভপাতের রক্তপাত বন্ধ হওয়ার পর প্রেগনেন্সি পরীক্ষায় যদি ফলাফল নেগেটিভ আসে কিংবা নিয়মিত মাসিক শুরু হয়, তখন থেকেই সন্তান ধারণের জন্য শরীর প্রস্তুত হয়ে যায়।এমন নানা ধরনের কনটেন্ট পেতে চোখ রাখুন আমাদের ওয়েবসাইটে। এছাড়া আপনারা আরো কি কি ধরনের কনটেন্ট পেতে চান সে বিষয়ে কমেন্ট বক্সে জানাতে ভুলবেন না