চিনি, শর্করা, সুগার যে নামেই ডাকুন, গত কয়েক দশকে বিজ্ঞানীরা ডাক্তারদের ক্রমাগত সতর্কবার্তার ফলে এটা হয়ে দাঁড়িয়েছে জনস্বাস্থ্যের এক নম্বর শত্রু। অনেক বিশেষজ্ঞ বলছেন, আমাদের খাবার থেকে চিনি সম্পূর্ণ বাদ দিয়ে দিতে। আমরা সব সময় শুনছি যারা বেশি মিষ্টি খান, তাদের টাইপ টু ডায়াবেটিস, হৃদরোগ এবং ক্যান্সারের ঝুঁকি বেশি। কিন্তু এর বিপরীতে একটা কথা আছে। আসলে এসব স্বাস্থ্য সমস্যার জন্য যে শর্করাই দায়ী তা হয়তো নাও হতে পারে। মিষ্টি কিভাবে আমাদের স্বাস্থ্যের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে তা বের করতে গিয়ে কিন্তু বিজ্ঞানীরা দেখছেন, এটা প্রমাণ করা খুব কঠিন।
উচ্চ রক্তচাপ বা কোলেস্টোরেলের মত সমস্যার ঝুঁকি তখনই হয় যখন আপনি উচ্চ ক্যালরির সমৃদ্ধ খাবারের সাথে উচ্চমাত্রায় শর্করা সমৃদ্ধ খাবার খাচ্ছেন। তারা আরও বলছেন যে, শুধু মিষ্টি বা মিষ্টিজাতীয় খাবারের জন্য স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি হয় এটা বলা যায়না। তাছাড়া একটি খাবারকে সমস্যার মূল কারণ বলে চিহ্নিত করার অনেক বিপদ আছে। কারণ এর ফলে এমন হতে পারে মানবদেহের জন্য প্রয়োজনীয় কোন খাবার হয়তো আপনি খাওয়া বন্ধ করে দিলেন।
চিনি শক্তির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কিন্তু এই চিনি বা শর্করা জাতীয় খাবার বা মিষ্টি খাওয়া নিয়ে আমাদের মাঝে ভীতির শেষ নেই। মিষ্টি নিয়ে কিন্তু নানাজাতীয় কথা প্রচলিত আছে। চলুন আজ কয়েকটা জেনে নেয়া যাক।
মিষ্টি বা চিনি জাতীয় খবার খেলে ওজন বাড়েঃ

বাঁচতে হলে চিনি ছাড়ুন, মিষ্টি ছাড়ুন। এই কথার কোন ভিত্তি নেই। অতিরিক্ত মিষ্টি শরীরের জন্য ক্ষতিকর। চিনিযুক্ত খাবার এর অনেক ক্যালোরি থাকে আর অনেক ক্যালোরি গ্রহণ করলে তা মিষ্টি খাবার থেকে হোক বা অন্য কোন উপায়ে, ওজন বাড়বে এটাই তো স্বাভাবিক। পুষ্টিবিদেরা বরাবরই বলে আসছেন, চিনিজাতীয় খাবার পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়ার কোন প্রয়োজন নেই। কিন্তু দৈনন্দিন খাবারের চাহিদা মেটাতে, কি পরিমাণ মিষ্টি জাতীয় খাবার প্রয়োজন সেটা জানতে হবে। কারণ শরীরের যতটুকু মিষ্টি দরকার, ততটুকু নিতে হবে। কম বা বেশি দুটোতেই বিপত্তি।
মিষ্টি খেলে ডায়াবেটিকস হয়ঃ

বিজ্ঞানীরা বলছেন, উচ্চমাত্রার ফ্রুক্টোজ সমৃদ্ধকরণ কর্ন সিরাপ বা বাড়তি চিনিও য়ালা পানিয়, জুস ড্রিংক অথবা সাদা চিনি এগুলো হূদযন্ত্রের সমস্যা তৈরি করতে পারে। কারণ তা ধমনীর ভেতর ট্রাইগ্লিসারাইড জাতীয় চর্বি কমাতে ভূমিকা রাখে। বিভিন্ন জরিপে এই বাড়তি যোগ করা মিষ্টি সমৃদ্ধ খাবার বা পানীয় সাথে বিতর্ক হৃদরোগ বা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার সম্পর্ক দেখা গেছে। কিন্তু চিনির কারণেই যে হৃদ রোগ বা ডায়াবেটিস হয় এটা স্পষ্ট করে বলার উপায় এখনো নেই।লুজান বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক লোকটাকে বলছেন, অতিরিক্ত ক্যালোরি ডায়াবেটিস স্থূলতা এবং উচ্চ রক্তচাপের কারণ এবংসুগার সেই উচ্চ ক্যালোরী সমৃদ্ধ খাবারের একটা অংশ মাত্র। এ ছাড়া টাইপ ১ ডায়াবেটিস, টাইপ 2 ডায়াবেটিস, জেনেটিক ও পরিবেশগত কারণে হয়ে থাকে। সেখানে শুধুমাত্র মিষ্টি জাতীয় বা শর্করা জাতীয় খাবার কে দোষারোপ করা ঠিক নয়।
অতিরিক্ত মিষ্টি মস্তিষ্কে প্রভাব ফেলেঃ
অনেকে বলে থাকেন, বাচ্চাদের হাইপার একটিভ করে তুলে মিষ্টিজাতীয় খাবার। কিন্তু গবেষকরা বলছেন, এর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই।। কিছু গবেষণায় বলা হয়, মিষ্টি খাওয়ার আকর্ষণ, কোকেনের আকর্ষণের মতোই। বলা চলে একটা নেশা। কিন্তু এসব গবেষণার বিরুদ্ধে এমন সমালোচনাও হয়েছে যেখানে উপাত্তকে ভুল ভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। কিছু জরিপে বলা হয়, যারা বেশি বেশি কোমল পানীয় বা ফলের রস খান, তাদের স্মৃতিশক্তি দুর্বল। মস্তিষ্কের গড় আয়তন ও কম।
কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার সুইনবার্ন সেন্টারের গবেষক বলছেন, তিনি নিশ্চিত নন যে মস্তিষ্কের স্বাস্থ্যের ওপর শুধু শর্করায় প্রভাব ফেলে। তিনি বলেন, এমনও হতে পারে যারা বেশি সফট ড্রিংকস পান করেন তারা হয়তো শরীর চর্চা করেন কম। মস্তিষ্কের স্বাস্থ্যের সাথে তো এর একটা সম্পর্ক থাকতে পারে। অন্য কিছু গবেষণায় আবার এটাও দেখা গেছে যে, বয়স্ক মানুষদের ক্ষেত্রে শর্করা স্মৃতিশক্তি বাড়াতে এবং দুরূহ কাজ করার ক্ষমতা বাড়াতে সহায়ক হতে পারে।
যারা ক্রীড়াবিদ, তারা বেশি মিষ্টি বা শর্করা গ্রহণ করলেও শারীরিক পরিশ্রম বেশী করছেন বলে তা হজম হয়ে যাচ্ছে। কোন ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে না।
এই চিনি ভালো না ওই চিনি ভালোঃ
সব ধরনের চিনি শরীরে একি প্রভাব ফেলে, সেটা সাদা হোক বা লাল হোক।বা এগুলো দিয়ে তৈরি মিষ্টি জাতীয় খাবার হোক। অনেকে কৃত্রিম সুইটনারও গ্রহণ করেন। কিন্তু আমেরিকান ডায়াবেটিস অ্যাসোসিয়েশনের গবেষণায় দেখা গেছে কৃত্রিম সুইটনার গ্রহণকারীদের ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা অনেক সময় বেশি থাকে।
স্বাস্থ্যের সকল সমস্যার মূলে মিষ্টি বা চিনি জাতীয় খাবার?
স্থুলতার জন্য মিষ্টি খাবারের একটা ভূমিকা থাকে, এতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করলে মিষ্টি বা মিষ্টি জাতীয় খাবার স্থূলতার কারণ হতে পারবেনা।। খাদ্য বিশেষজ্ঞর রেনি ম্যাকগ্রেগর বলছেন, আমাদের প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই সুষম খাবারের সংজ্ঞা ভিন্ন ভিন্ন। আসলে খাদ্য তালিকা থেকে চিনিকে বাদ দিয়ে দেওয়া টা বরং হিতে বিপরীত হতে পারে। এমনও হতে পারে মিষ্টি বাদ দিয়ে আপনি হয়তো অতিরিক্ত ক্যালরি সমৃদ্ধ কোন খাদ্য বেশি খেতে শুরু করলেন, তাতে ক্ষতি বেশি। মিষ্টিজাতীয় খাবার নিয়ে জোরালো বিতর্ক আছে বলেই আমাদের মধ্যে বিভ্রান্তির ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। স্বাস্থ্যকর কিছু ফল, যেগুলোতে শর্করা আছে তার সাথে কোমল পানীয়তে গুলিয়ে ফেলছি। যাতে বাড়তি শর্করা ছাড়া কোন পুষ্টিকর উপাদান নেই। তাহলে মিষ্টিজাতীয় খাবার মানেই সেটা খারাপ, ব্যাপারটা আমরা এরকম নেতিবাচকভাবে চিত্রিত করি কেন?
এর একটা কারণ হল আমরা যে জিনিসটার আকর্ষণ ঠেকাতে পারি না সেটাকেই অশুভ হিসেবে চিত্রিত করি। মিষ্টি খাবার তারনা নিয়ন্ত্রণ করতে ও আমরা একই জিনিস করছি। মিষ্টিজাতীয় খাবার নিয়ে ভুল ধারনা থাকলেও এটা সম্পর্কে কিছু বিষয়ে সত্যি। বেশি পরিমাণে মিষ্টি খাবার না খেয়ে পরিমিত খাওয়াই সবচেয়ে ভালো সমাধান।