চোখ ওঠা বা ডাক্তারি ভাষায় কনজাংটিভাইটিস। এটি চোখের এক ধরনের সংক্রমণ। যার কারণে চোখ লাল হয়ে যায়। এতে মূলত চোখের ওপরের আবরণট কনজাংটিভায় প্রদাহের সৃষ্টি হয়। কেন চোখ উঠে? এর চিকিৎসা কি? কখন ডাক্তারের কাছে যাবেন? এমন প্রশ্নের উত্তর পাবেন এই আলেচনায়।
চোখ ওঠা: চেখ ওঠে কেন? কিভাবে ছড়ায়?
চোখ ওঠা বেশ ছোঁয়াচে রোগ। চোখ ওঠা ব্যক্তির ব্যবহার্য চশমার রুমাল, টিস্যু, বালিশ বা প্রসাধনী অন্যরা ব্যবহার করলে তারাও আক্রান্ত হতে পারেন। এটি বাতাসের মাধ্যমে ছড়ায়। তাই আক্রান্ত ব্যক্তির আশেপাশে থাকলেও সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। এছাড়া অপরিচ্ছন্ন জীবনযাপন চোখ ওঠার বড় কারণ। বৃটেনের জাতীয় স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের মতে, মূলত তিনটি কারণে চোখ উঠতে পারে। সেগুলো হলোঃ
১.ব্যাকটেরিয়া, ২. ভাইরাস এবং ৩.এলার্জি।
চোখে ব্যাকটেরিয়া ভাইরাসের সংক্রমণকে ইনফেক্টিভ কনজাঙ্কটিভাইটিস বলে। ভাইরাসের সংক্রমন হলে চোখ ফুলে যায়, বারবার পানি পড়ে। এবং ব্যাক্টেরিয়ার সংক্রমনের ফলে হলুদ বা সবুজ রঙের আঠালো পুচ জমবে। ফুলের রেণু, পশু পাখির পালক, ধুলোবালির এলার্জি থাকলে তার প্রতিক্রিয়ায় চোখ উঠতে পারে। একে এলার্জিক কনজাংটিভাইটিস বলে। বিভিন্ন পদার্থের সংস্পর্শে চোখ জ্বালাপোড়া করতে পারে। যেমন শ্যাম্পু, সাবান বা সুইমিং পুলের ক্লোরিনযুক্ত পানি।,ধোঁয়া, এমনকি চোখের আলগা পাপড়ি, ল্যাশ এক্সটেনশন এ ব্যবহৃত কেমিক্যাল ওয আঠার ঘষায় চোখ উঠতে পারে। একে ইরিটেড কনজাংটিভাইটিস বলা হয়। এছাড়া বিভিন্ন প্রসাধনী, সংক্রমিত কন্টাক্ট, লেন্স, চশমা, রাসায়নিক কিংবা আই ড্রপ এর প্রভাবেও চোখ উঠতে পারে। আবার বিভিন্ন যৌনবাহিত সংক্রমণ যেমন ক্ল্যামিডিয়া ও গনোরিয়ার প্রভাবেও চোখ ওঠার আশঙ্কা থাকে।
লক্ষণঃ
চোখের সাদা অংশ লাল বা টকটকে লাল দেখাবে। প্রথমে একচোখ আক্রান্ত হয়, তারপর অন্য চোখে ছড়িয়ে পড়ে। চোখে চুলকানি, জালাপোড়া বা খচখচে ভাব, চোখের ভেতরে কিছু আছে এমন অনুভূতি হয়,চোখে বারবার পানি পড়ে, চোখের পাতায় পুঁজ জমে এবং পাপড়ি আঠার মতো লেগে থাকে। বিশেষ করে ঘুম থেকে ওঠার পর চোখের পাতা খুলতে কষ্ট হয়। চোখের পাতা লাল হয়ে ফুলে চোখ বন্ধ হওয়ার অবস্থা হয়। দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে।
বাড়িতে কীভাবে চিকিৎসা নেবেন?

চোখ ওঠার এমন অস্বস্তিকর লক্ষণগুলো কমাতে কিছু ব্যবস্থা নিতে পারেন। প্রথমে এক টুকরো তুলো বা সাদা রঙের পরিষ্কার নরম সুতির কাপড় গরম পানিতে ডুবিয়ে চেপে নিয়ে আলতো হাতে ওই কাপড় দিয়ে চোখের পাতা ও পাপড়ি পরিষ্কার করতে হবে দিনে কয়েকবার। দুটি চোখের জন্য আলাদা আলাদা কাপড় বা তুলো আলাদা পানির পাত্র ব্যবহার করতে হবে। গরম সেঁক দেও আর কয়েক মিনিট পর বরফ ঠাণ্ডা পানিতে কাপড় ও তুলো ডুবিয়ে ঠাণ্ডা শেক দেওয়া যেতে পারে। এ সময় চোখে চাপ পড়ে এমন কাজ করা যাবে না। যেমন বেশিক্ষণ মোবাইল, কম্পিউটারে থাকা ছোট ছোট লেখাপড়া।
কখন ডাক্তারের কাছে যাবে?
চোখ ওঠার ক্ষেত্রে সাধারণত ডাক্তারের কাছে যাবার প্রয়োজন নেই। কারণ এটি 7 থেকে 10 দিনের মধ্যে ঠিক হয়ে যায়। তবে কিছু লক্ষণ দেখা দিলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
১.চোখ ওঠার উপসর্গ দুই সপ্তাহ পরেও ঠিক না হলে, ২.চোখে বারবার ময়লা জমলে
৩.শিশুর চোখ লাল হয়ে গেলে বিশেষ করে শিশুর বয়স 28 দিনের কম হলে জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসকের সাথে কথা বলতে হবে।
৪. চোখ চুলকানোর সাথে সাথে চোখে ভীষণ ব্যথা, মাথাব্যথা, অসুস্থতা এবং চোখে যখম হলে।
৫.আলোর প্রতি সমবেদনা শীলতা অর্থাৎ আলোর দিকে তাকালে চোখ ব্যথা করলে।
৬. দৃষ্টিতে কোন ধরনের পরিবর্তন এলে যেমন কাঁপাকাঁপা রেখা বিদ্যুৎ চমকানোর মতো ঝলকানি দেখলে দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এলে।
৭. যারা নিয়মিত কন্টাক লেন্স পরেন, তাদের চোখ ওঠার উপসর্গ দেখা দিলে চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। কারণ ওই লেন্সের কারণেও চোখের অ্যালার্জি বা প্রদাহ হতে পারে।
চিকিৎসাঃ
চোখ ওঠার চিকিৎসা কেমন হবে তা নির্ভর করবে চোখ ওঠার কারণের উপর। ব্যাক্টেরিয়ার সংক্রমনের কারণে চোখ উঠলে চিকিৎসক অ্যান্টিবায়োটিক আইড্রোপ মলম দিতে পারেন।ভাইরাস বা এলার্জির কারণে চোখ উঠলে অ্যান্টিহিস্টামিন বা অ্যান্টি এলার্জির ওষুধ, আই ড্রপ, মলম দেয়া হতে পারে। রোগীর যেসব বিষয় এলার্জি আছে সেগুলো এড়িয়ে চলা বেশ জরুরী। যেমন ধুলোবালি, ফুলের রেনু, সুইমিং পুলের পানি, বিশেষ কোনো প্রসাধনী, রাসায়নিকের প্রভাবে এর চোখ উঠলে সেগুলো সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতে হবে।
কী করবেন, কী করবেন নাঃ
আগের বলা নিয়মে দিনে কয়েকবার চোখ পরিষ্কার করতে হবে। চোখ চুলকালেও কোন অবস্থায় চোখ হাত দিয়ে ঘষা ঘষি বা রগরানো যাবে না। চোখে হাত গেলে অবশ্যই সাবান পানিতে হাত ধুয়ে নিতে হবে। বালিশের কভার, মুখ মোছার গামছা, তোয়ালে, চশমা নিয়মিত গরম পানিতে ডিটারজেন্ট দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে। এ সময় নিজের তোয়ালে, চশমা কারো সাথে শেয়ার করবেন না । হাচি দেয়ার সময় আপনার নাক মুখ ঢেকে রাখুন এবং ব্যবহৃত টিস্যু ময়লার ঝুড়িতে ফেলে দিন। চোখ সম্পূর্ণ ঠিক না হওয়া পর্যন্ত কন্টাক লেন্স পরা জাবে না । ইনফেকশন থাকা অবস্থায় কোন লেন্স পড়ে থাকলে সেটা ফেলে দিতে হবে। আক্রান্ত চোখে কোন প্রসাধনী দেয়া যাবেনা।
এলার্জি এড়াতে কালো চশমা বা সানগ্লাসের চোখ ঢেকে রাখতে পারেন। কোনো আইড্রপ এর মেয়াদ প্যাকেট 1/2 বছর লেখা থাকলেও একবার মুখ খুললে 28 দিনের বেশি ব্যবহার করা যাবে না।চোখ উঠলেই যে স্কুলে বা কাজে যাওয়া বন্ধ করতে হবে বিষয়টা তা নয়। তবে স্কুলে অনেক মধ্যে এই রোগ ছড়িয়ে পড়লে কিছুদিন শিশুকে আলাদা রাখাই ভালো। এছাড়া যাদের অন্যের সংস্পর্শে কাজ করতে হয় একই টেলিফোন ও কম্পিউটার শেয়ার করতে হয়, তারা পুরোপুরি সেরে ওঠার আগে কাজে যোগ না দেয়াই ভালো।
ঝুঁকি কাদের বেশিঃ
প্রবীন ও শিশুদের মধ্যে চোখ ওঠা বেশ সাধারণ রোগ। শিশুরা স্কুল বা খেলার মাঠ থেকে অন্যের সংস্পর্শ থেকে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। এছাড়া বয়স্ক ব্যক্তিদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকায় তারাও ঝুঁকিতে থাকেন। যদি কেউ সম্প্রতি শ্বাসনালির সংক্রমণ যেমন সর্দি জ্বরে আক্রান্ত হয়ে থাকেন। তাহলে তার চোখ ওঠার ঝুঁকি বেশি থাকে। ডায়াবেটিস বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল করে এমন কোনো অসুখ থাকলে বা কাউকে নিয়মিত স্টেরয়েড নিতে হলে তার চোখ ওঠার ঝুঁকি বেশি থাকে। চোখের পাতায় ব্যাকটেরিয়া সংক্রমিত প্রদাহ ব্লেফারাইটিস থাকলে চোখ উঠতে পারে। যারা নিয়মিত জনসমাগমস্থলে যেমন বাস স্টপ, ট্রেন স্টেশন, লঞ্চঘাট বা জনসমাবেশের চলাচল করে, তাদের মধ্যে সহজেই চোখ ওঠা সংক্রমিত হতে পারে।