কী পরিমান পানি পান করা উচিত: পানিকে জীবনের আরেক নাম বলা হয়। কারণ আমাদের শরীর চালিয়ে নেয়ার জন্য যত কাজ আছে যেমন খাবারের পুষ্টিগুণ ছড়িয়ে দেয়া, বর্জ্য বের করা, তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা, হাড়ের যয়েন্টগুলো লুব্রিকেন্ট সরবরাহ করা, যেন যেকোনো শোষণ করতে পারে, সেই সাথে শরীরের ভেতরে বেশিরভাগ রাসায়নিক বিক্রিয়া তে ভূমিকা পালন করে এই পানি। এর ফলে মস্তিষ্ক, হৃদপিন্ড, ফুসফুস ঠিকভাবে কাজ করে। চেহারায় বয়সের ছাপ দেরীতে পরে। ওজন নিয়ন্ত্রণে আসে। তবে এই পানি পান নিয়ে নানা ধরনের পরামর্শ আমরা শুনে থাকি সাম্প্রতিক গবেষণায় ভুল বলে প্রমাণিত হয়েছে। সেই বিষয়গুলো আজকে আমরা ব্যাখ্যা করব।
বেশি পানি পানে বেশি উপকারঃ

বিশুদ্ধ পানি সস্তা ও সহজলভ্য হওয়ায় আজকাল মানুষ তার প্রয়োজনের তুলনায় বেশি পানি পান করছে বলে সাম্প্রতিক এক গবেষণায় উঠে এসেছে।
এই বেশি বেশি পানি পান আরেকটা বড় কারণ পানি নিয়ে বিভিন্ন তথ্য ছড়ানো। যেমন যে যত বেশি পানি খাবে সে তত সুস্থ থাকবে, শক্তিশালী হবে, ত্বক চকচক করবে, ওজন কমবে, এমনকি ক্যান্সারের ঝুঁকিও নাকি কমে যাবে অথচ আমাদের শরীরে যতটা পানি প্রয়োজন ততটুকু খাওয়াই সুস্থতার জন্য যথেষ্ট। এর চেয়ে বেশি পানি খেলে যে উপকার হবে এই তথ্যের তেমন কোনো প্রমাণ নেই বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন।
প্রয়োজনীয় পরিমাণ পানি আসলে কতোটুকু?
প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের প্রতিদিন কমপক্ষে কি পরিমাণ পানি খাওয়া প্রয়োজন, সেটা নির্ধারণের সবচেয়ে জনপ্রিয় হলো 8/8 ফর্মুলা। জার্মানে প্রতিদিন 8 বার আট অাউন্স করে পানি পান করা। 8 আউন্স হল 240 মিলিমিটারের কিছুটা কম। সাধারণত এক গ্লাসে পরিমাণ পানি ধরে। সে হিসেবে কেউ যদি প্রতিদিন 8 আউন্স বা 8 গ্লাস পানি খান, তাহলে তার সারাদিনে দুই লিটার এর মত পানি খাওয়া হয়ে যায়।
গ্লোবাল হেপেন খবর পেতে ফলো করুন আমাদের গুগল নিউজ চ্যানেল
এর বাইরে চা-কফি, শরবত এর মত অন্যান্য পানি তো আছে। কিন্তু পানি খাবার এ ফর্মুলাকে আধুনিক বিজ্ঞান সমর্থন করেনা। 2022 সালে এবার্ডিন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা জানিয়েছেন, প্রতিদিন 8 গ্লাস পানি শরীরের প্রয়োজনের চাইতে বেশি হয়ে যায়। এক্ষেত্রে একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির জন্য পানির আদর্শ পরিমাণ বলা হচ্ছে প্রতিদিন দেড় লিটার থেকে 1 লিটার 800 কিলোমিটারের মত। অর্থাৎ প্রতিদিন 6 থেকে 7 গ্লাস কিংবা তার সামান্য কিছু বেশি পানি খেলেই হবে। বিভিন্ন দেশের 23 জন বিজ্ঞানীদের সাথে সমন্বয় করে এই পানির পরিমাণ ঠিক করা হয়েছে।
এর মধ্যে ফল এবং সবজি থাকা পানি, চা-কফি, শরবত, কোমল পানীয় অন্তর্ভুক্ত থাকবে। অর্থাৎ কেউ যদি এক গ্লাস পরিমাণ শরবত খান তাহলে তিনি চাইলে এক গ্লাস পানি বাদ দিতে পারেন। তবে পানীয় হিসেবে পানি সবচেয়ে স্বাস্থ্যকর। কারণ এতে কোনো ক্যালোরি নেই। অন্যান্য পানীয় শরীরকে আর্দ্র করে ঠিকই, কিন্তু চা, কফি বা ক্যাফেইন জাতীয় পানীয় সেই সাথে অ্যালকোহলযুক্ত পানীয় মূত্রবর্ধক হয়ে থাকে। ফলে এতে শরীর আর্য যেমন হবে, তেমনি দ্রুত সেটি প্রস্রাবের মাধ্যমে শরীর থেকে বেরিয়ে যাবে। তবে যারা গরম এবং আর্দ্র পরিবেশে থাকেন, উচ্চ কোথায় বাস করেন, প্রচুর পরিশ্রম করতে হবে, বা খেলাধুলা করেন, সেই সাথে গর্ভবতী এবং বুকের দুধ খাওয়ানো নারীদের অন্যদের তুলনায় বেশি পানি পান করতে হবে বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন।
তৃষ্ণা মানেই বিপদ?
পানি নিয়ে আরেকটি অপ্রমাণিত দাবি হচ্ছে কেউ যদি তৃষ্ণা অনুভব করেন এর মানে হলো তিনি ইতোমধ্যে বিপজ্জনকভাবে পানিশূন্য হয়ে গিয়েছেন। পানিশূন্যতার অন্যান্য লক্ষণ গুলোর মধ্যে রয়েছে গাঢ় হলুদ প্রস্রাব,ক্লান্তিবোধ বা হালকা মাথা ব্যাথা, মাথা ঘোরানে,মুখ,ঠোট এবং চোখ শুষ্ক হওয়া, এবং দিনে ৪ বার এর কম প্রস্রাব করা। এসব লক্ষণ দেখা দেওয়া মানে, আপনি যে পরিমাণ তরল গ্রহণ করছেন, তার চেয়ে বেশি ত্বরণ হারাচ্ছেন। তৃষ্ণা পাওয়া হলো শরীরের একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। শরীর পানিশূন্য হয়ে গেলে একটি সুস্থ শরীর ও মস্তিষ্ক সেটা শনাক্ত করে এবং তৃষ্ণার অনুভূতি জাগায়। যেন মানুষ পানি পান করে। পানিশূন্যতা দেখা দিলে শরীরে এক ধরনের হরমোন নিঃসরণ হয়, যা কিডনিকে প্রস্রাব ঘন করে জল সংরক্ষণ করার জন্য সংকেত দেয়।
আমাদের শরীর এক থেকে দুই শতাংশ পানি হারিয়ে ফেললে এ পানিশূন্যতার লক্ষণ গুলো দেখা দিতে শুরু করে। যতক্ষণ না আমরা পুনরায় পানি খেয়ে সে ঘাটতি পূরণ করছি, ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের পানিশূন্যতা বাড়তেই থাকে এবং তা মারাত্মক হতে পারে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে তৃষ্ণা পাওয়া মানেই শরীর বিপজ্জনকভাবে পানিশূন্য হয়ে গেছে। বড় বিশেষজ্ঞরা অনেকাংশে সম্মত হয়েছে, আমাদের শরীরে যে পরিমাণ পানি পানের জন্য সঙ্কেত দেয়, তার চেয়ে বেশী তরল আমাদের প্রয়োজন হয় না। তবে হ্যাঁ, তৃষ্ণা পাওয়ার পরেও আপনি যদি পানি না খান, তাহলে সেটা শরীরের চাপ সৃষ্টি করবে, আবার এটি মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ আমাদের তৃষ্ণা’র অনুভূতি 60 বছর বয়সের পর তেমন একটা সংবেদনশীল থাকে না।
ফলে অল্প বয়সের তুলনায় বয়স্কদের পানিশূন্য হওয়ার আশঙ্কা বেশি। সে ক্ষেত্রে বয়স হলে তৃষ্ণার ওপর নির্ভর করলে চলবে না। বেশি পানি পান করার আরেকটি কথিত উপকারিতা আছে। এতে নাকি ত্বকের রং উজ্জ্বল হয়। কিন্তু এর পেছনে বিশ্বাসযোগ্য বৈজ্ঞানিক তথ্য প্রমাণের অভাব আছে।
বেশি পানি বিপদজনকঃ
শরীরে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি বেশি পানি পান করলে কখনো কখনো তা বিপদজনক হয়ে পড়তে পারে। কেননা অতিরিক্ত পানি রক্তে সোডিয়ামের তরলীকরণ ঘটায়। এর ফলে মস্তিষ্ক এবং ফুসফুসে পানি জমে যায়। কেননা রক্তে সোডিয়ামের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য শরীরে এ অতিরিক্ত তরল বিভিন্ন জায়গায় জমা করে। এমন ওভার হাইড্রোজেন বা হাইপোনেট্রেমিয়া শিকার হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে অন্তত 15 জন ক্রীড়াবিদ মারা গিয়েছিলেন। গবেষকরা বলেছেন, প্রয়োজনের চেয়ে বেশি পানি পান করলে আপনাকে বারবার টয়লেটে যেতে হবে। এর চেয়ে আর কোন উপকার নেই।
পানি খেলে ওজন কমেঃ
ভার্জিনিয়া পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট এবং স্টেট ইউনিভার্সিটির খাদ্য ও পুষ্টি বিভাগের অধ্যাপক পাণিগ্রহণ এবং ওজন নিয়ে গবেষণা করেছেন।। এ গবেষণায় তিনি দুটি দলের ওপর পরীক্ষা চালান, দুটি গ্রুপকে তিন মাসের জন্য স্বাস্থ্যকর ডায়েট অনুসরণ করতে বলা হয়। তবে শুধুমাত্র একটি গ্রুপের সদস্যদের বলা হয় প্রতিবার খাবার খাওয়ার আধা ঘণ্টা আগে 500 মিলিলিটার বা দুই গ্লাসের মত পানি খেতে। যে দলটি খাবার খাওয়ার আগে পানি পান করেছে তাদের ওজন অন্য দলের চেয়ে বেশি কমেছে। উভয় গ্রুপকে দিনে 10 হাজার কদম হাঁটতে বলা হয়েছিল।
তবে যারা হাটার আগে পানি পান করেছেন তারা এ হাঁটার কাজটা আরো ভালোভাবে করতে পেরেছেন। তবে ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের ইনটেনসিভ কেয়ার মেডিসিনের অধ্যাপক বারবার বলেছেন খাওয়ার আগে পেট ভরে পানি খেলে ওজন কমবে এই ধারণা সঠিক নয়। কেননা পানি খেলে পেট থেকে সেই পানি দ্রুত বেরিয়ে যায়। তিনি বলেছেন, কেউ যদি খাবারের মাধ্যমে বেশি পানি পান করে, যেমন স্যুপ জাতীয় খাবার খান সেটা শরীরের পানিস্বল্পতা পুরনো যেমন কাজ করবে, তেমনিএ পানি খাবার এর সাথে যুক্ত থাকে সেটাও পেটে বেশিক্ষণ থাকবে। আর ওজনও কমবে। মোটকথা পানি খাওয়ার ক্ষেত্রে ভারসাম্য রাখতে হবে।
আমরা ক্রমাগত ঘাম, প্রস্রাবের মাধ্যমে পানি হারাচ্ছি। প্রয়োজন বুঝে পানি পান করা প্রয়োজন। যেন আমাদের শরীরে পানি হারানোর ফলে শুষ্ক না হয়ে যায়। শরীর যেন পানি গ্রহণ ও হারানোর একটা ভারসাম্যের মধ্যে থাকে। এমন নানা ধরনের কনটেন্ট পেতে চোখ রাখুন আমাদের ওয়েবসাইটের। এছাড়া আপনারাআর কি ধরনের কনটেন্ট চান সে বিষয়ে আমাদেরকে কমেন্ট বক্সে জানাতে ভুলবেন না।