ঠিক কবে থেকে মানুষ খাবারে মসলা ব্যবহার করে আসছে সেটা বলা কঠিন। কিন্তু খুব সহজে বলা যায় যে, হাজার হাজার বছর ধরে মানুষের খাদ্যাভ্যাস এর একটি অংশ হলো মসলা। সেই আদিকাল থেকেই খাবারের স্বাদ বাড়াতে নানা ধরনের মসলা ব্যবহার করা হয়। বিশেষ করে খাদ্যের সঙ্গে গ্রন্থ ও রং করা এবং খাবার সংরক্ষণের নানা ধরনের মসলার রয়েছে বিশেষ ভূমিকা। এসব মশলা বিশেষ করে হলুদ, মরিচ , আদা, জিরা সহ বিভিন্ন মসলা নিয়ে সাম্প্রতিক কালে ব্যাপক গবেষণা হচ্ছে এসব মসলার স্বাস্থ্যের জন্য কতটা উপকারী এগুলো কি সত্যিই রোগ প্রতিরোধ ও প্রতিকারের সাহায্য করে? কোন এগুলোর মধ্যে কি আমাদের স্বাস্থ্যের ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে? এসব তথ্য আজ আপনাদের জানানোর চেষ্টা করব।
মসলায় যেসব গুনাগুন লুকিয়ে আছেঃ

বিজ্ঞানীরা বলছেন, মসলার মধ্যে যেসব রাসায়নিক উপাদান আছে সেগুলো নানা ধরনের রোগ প্রতিরোধ ও প্রতিকারের সাহায্য করে থাকে। এগুলোর মধ্যে থেকে এসব উপাদান সংগ্রহ করে সেগুলো এখন বিকল্প ওষুধ হিসেবেও ব্যবহৃত হচ্ছে। যদিও অনেকে অভিযোগ করেন যে প্রচুর মসলাযুক্ত খাবার খাওয়ার ফলে তারা বুক জ্বালা ও গ্যাস পিক সহ নানা ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগে থাকেন। কিন্তু বিজ্ঞানীদের বক্তব্য হলো, যে কোন খাবারে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি খেলে ক্ষতি হবে। যত পুষ্টিকর খাবারই হোক সব খাবার খাওয়ার একটা পরিমাণ আছে।। দুধ ও ডিমের মতো পুষ্টিকর খাবারের ক্ষেত্রে যেমন এ কথা প্রযোজ্য।
মশলার ক্ষেত্রেও তাই। বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে যে, দৈনন্দিন খাবারে যে সব মসলার ব্যবহার হয়, সেগুলো স্বাস্থ্যের অনেক উপকারে আসে। হলুদ, রসুনের মতো কিছু মসলায় যেমন অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল জীবাণু-প্রতিরোধী উপাদান রয়েছে। তেমনি মেথি, পেঁয়াজ, হলুদ ও রসুনের মতো কিছু মসলা ডায়াবেটিস প্রতিরোধ এবং নিয়ন্ত্রণেও কাজ করে বলে জানাচ্ছেন গবেষকেরা। এসব মশলা রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ কমাতে সহায়তা করে। আমাদের প্রতিদিনের রান্নায় যেসব এগুলোর মধ্যে আমরা ব্যবহার করি তার মধ্যে অন্যতম হলো লাল মরিচ, হলুদ, রসুন, আদা, ধনে, জিরা, দারুচিনি, লবঙ্গ, তেজপাতা ইত্যাদি।
হলুদঃ
জনপ্রিয় একটি মশলা হলো। এ মশলাটি নিয়ে সবচেয়ে বেশি গবেষণা হয়েছে। পুষ্টি বিজ্ঞানীদের মতে হলুদের চিকিৎসা গ্রহণ অভাবনীয়। আয়ুর্বেদিক চিকিৎসার কয়েক হাজার বছর ধরে হলুদ ব্যবহৃত হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক পুষ্টিবিজ্ঞানী নাজমা শাহীন বলেছেন, আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় হলুদ কে বলা হয় হার্টের টনিক।এটি রক্তকে পাতলা রাখে। লিভারের কার্যক্ষমতা বাড়ায়, হার্টকে শক্তিশালী করে রক্তনালিতে ব্লাড জমে যাবে সেখানে ব্লক তৈরি না হয় তাতেও ভূমিকা রাখে এই মসলাটি। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এই হলুদ। হলুদ এর মধ্যে যে কারকুমিন’ উপাদান আছে তার অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ভূমিকা রয়েছে । নানা কারণে শরীরের যেসব ফ্রিরেডিকেল তৈরি হয়, সেগুলো বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের নানা ধরনের ক্ষতি করে।
ফ্রিরেডিকেল নিয়ন্ত্রণেও হলুদের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য বলে জানাচ্ছে বিজ্ঞানীরা। নিকোটিনের ফুসফুসের যে ক্ষতি হয় সেটাতে ও প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। এটি নিউরো প্রটিক্টিভ হিসেবে কাজ করে। যে কারণে এখন আলসার রোগীদের চিকিৎসা তেও কারকুমিন’ ব্যবহার করা হচ্ছে। ক্ষত সারিয়ে তুলতে সাহায্য করে হলুদ।। ফলে কোথাও কেটে গেলে অনেকে কিন্তু সেখানে হলুদ লাগিয়ে নিয়ে তাৎক্ষণিক চিকিৎসা করে থাকেন। ক্যান্সারসহ ডায়াবেটিস প্রতিরোধে ভূমিকা রয়েছে হলুদের। চোখে ছানি পড়া থেকেও রক্ষা করে হলুদের কারকুমিন’। হাটুতে ব্যথার শহর শরীরের নানা ধরনের প্রদাহ প্রতিরোধ করতেও এর ভূমিকা রয়েছে।
লাল মরিচঃ
সবচেয়ে পরিচিত ও বহুল ব্যবহৃত একটি এগুলোর মধ্যে হলো লাল মরিচ। এর মূল সক্রিয় উপাদান হলো ক্যাপসাইসিন নামের একটি বায়ো অ্যাক্টিভ কম্পাউন্ড। এটি আমাদের লিভারেও রক্তে কোলেস্টেরলের পরিমাণ কমাতে সাহায্য করে। এর প্রধান কাজ দেহের চর্বি বার্ন করা। বিভিন্ন গবেষণায় বলা হচ্ছে, মানুষের দীর্ঘায়ুর পেছনে এই ক্যাপসাইসিন এর ভূমিকা রয়েছে। এছাড়াও এটি লিভারকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করে যে, সেখানে কোলেস্টরেল সিন্থেসিস কম হয়। অর্থাৎ অতিরিক্ত কোলেস্টরেল উৎপাদনে এটি বাধা সৃষ্টি করে। 2009 সালে ইতালির এক গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, যারা কখনো মরিচ খান নি তাদের তুলনায় যারা সপ্তাহে অন্তত চার দিন লাল মরিচ খান তাদের মৃত্যুর ঝুঁকি অনেক কম।
ধনেঃ
কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করে এই মসলা। এর মধ্যেও রয়েছে ডায়াবেটিস প্রতিরোধে গুণ। এটি রক্তে চিনির পরিমাণ কমাতে সাহায্য করে। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ব্যথা কমাতে এর ভূমিকা উল্লেখ যোগ্য। এছাড়াও এলার্জি ও হজমের ক্ষেত্রে এর ইতিবাচক ভূমিকা রয়েছে।
আদাঃ

এতে যেসব উপাদান আছে সেগুলোর রয়েছে এন্টিঅক্সিডেন্ট ভূমিকা। কোলন ক্যান্সারের সেল ধ্বংস করতে সাহায্য করে এর জিনজার উপাদান। এছাড়াও এর রয়েছে প্রদাহ নিরাময়ের ক্ষমতা। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে শক্তিশালী করে এই আদা। কাশি, বমি বমি ভাব ও বদহজম কমাতেও সাহায্য করে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, শরীরে ব্যথা , হাইপার্তেনশন, ডিমেনশিয়া, কোষ্ঠকাঠিন্য এবং আর্থাইটিস এর মতো বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধক নিরাময় এই মামলাটির ভূমিকা রয়েছে।
জিরাঃ
জিরায় যেসব উপাদান রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম একটি উপাদান হলো ফ্লাভনয়েড। এতে এপিদেমিওলজি আলিনুর রয়েছে এগুলো মূলত অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। এর প্রতিরক্ষামূলক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এ এন্টিঅক্সিডেন্ট গুলো ক্রনিক রোগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। পেটের সমস্যা ও ডায়াবেটিস প্রতিরোধেও এ মশলাটির ভূমিকা রয়েছে বলে জানাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা।
দারুচিনিঃ
দারুচিনি হলো অ্যান্টি-অক্সিডেন্টসমৃদ্ধ মসলা। এর মিষ্টি স্বাদ ও সুর্গন্ধের জন্য অনেক রান্নাতেই এগুলোর মধ্যে ব্যবহার করা হয়। বিশেষ করে মিষ্টি তৈরি, মজাদার কোন তরকারি রাধতে এই মসলার ব্যবহার বেশি দেখা যায়। এছাড়াও আয়ুর্বেদিক চিকিৎসাতে ও ব্যবহার হয় এই মসলার। চীনের ভেষজ ঔষধে যুগ যুগ ধরে দারুচিনির ব্যবহার হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ফাঙ্গাস অর্থাৎ শরীরের ছত্রাক জনিত সমস্যা প্রতিরোধে দারুচিনির ভূমিকা রয়েছে। উচ্চ রক্তচাপ কমাতে, বাতের ব্যথা ও শরীরের হাতের ব্যথা কমাতে এটি সাহায্য করে। স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধিতে, গলা ব্যথা ও খুসখুস কাশি তে, পেটের সমস্যা রোধে, ক্যান্সার প্রতিরোধে,, টাইপ টু ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করতে পারে এই মসলা।
লবঙ্গঃ
ছোট এ মসলা টির পুষ্টিগুণও কিন্তু অনেক। ভিটামিন ও মিনারেলের দারুন সমন্বয় আছে লবঙ্গে। লবঙ্গে আছে অ্যান্টি অক্সিডেন্ট যা ফ্রিরেডিকেল কমাতে সাহায্য করে। এছাড়া এতে ইওজেনালও ইসোইউজেনাল আছে, যা প্রদাহ প্রতিরোধে দারুণ কার্যকর বলে বিভিন্ন গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে। এছাড়া লবঙ্গে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল বৈশিষ্ট্য আছে যার ফলে ইকোলাই সহ বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া জনিত সমস্যা কমাতেও সাহায্য করে এই মসলাটি।