ধরুন আপনি হাঁটতে বের হয়েছেন বা জগিং করছেন। কিছু সময় পরেই আপনার বুক ধরফর শুরু হয়ে গেল, বা মনে হলো আপনার দম শেষ হয়ে গেছে। যে কোন শারীরিক পরিশ্রমের সময় নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হলে, বা হঠাৎ বুকে ব্যথা করলে হেলাফেলা করলে চলবে না কিন্তু। বিশেষজ্ঞদের মতে, ফুসফুসের স্বাস্থ্য খারাপ হলে এমন সব সমস্যা দেখা দিতে পারে, যা এই ক্যান্সারের প্রাথমিক লক্ষণ হতে পারে।
ফুসফুসের ক্যান্সারের লক্ষণগুলো কি? কোন ধরনের লক্ষণ দেখা দিলে ডাক্তারের কাছে যাবেন? এই ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে কী করবেন? এমন সব প্রশ্নের উত্তর পাবেন আমাদের আজকের এই আলোচনায়।
ফুসফুস মানবদেহের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ। আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বিশ্বে ফুসফুসের ক্যান্সার সবচেয়ে মারাত্মক হয়ে উঠেছে। যেসব ক্যান্সারের মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন, তার মধ্যে অন্যতম হলো ফুসফুসের ক্যান্সার। এ আক্রান্ত হয়ে বিশ্বজুড়ে মৃত্যু সংখ্যাও সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশের পুরুষরাও সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন এই ক্যান্সারে। নারীরাও এ ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছেন। যারা ধূমপায়ী তারা যেমন এই ধরনের ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে আছে। যারা ধূমপায়ী নন, তারাও আক্রান্ত হতে পারে ক্যান্সারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বশেষ তথ্য বলা হয়েছে, 2020 সালে 226771 জন ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছেন, এবং মৃত্যু হয়েছে 17 লাখ 96 হাজার 144 জনের। আর বাংলাদেশের আক্রান্ত হয়েছেন 12,999 জনে, মৃত্যু হয়েছে 12003 জনের।
ফুসফুসের ক্যান্সারের কারণঃ
এ ক্যান্সারের অন্যতম কারণ হিসেবে চিকিৎসকেরা মূলত ধূমপানকে চিহ্নিত করেন। এছাড়া যারা টোবাকো বা তামাক ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করেন এবং যাদের পরিবারের ধূমপায়ী ব্যক্তি রয়েছেন, তাদের এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। কারণ পরোক্ষ ধূমপানের মাধ্যমেও অনেকেই আক্রান্ত হয়ে থাকেন এই রোগে। আর ধূমপানের পরেই বায়ুদূষণ কে আরেকটি বড় কারণ হিসেবে চিহ্নিত করছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে, যে শহরে প্রচুর যানবাহন চলে, সেসব এলাকায় যানবাহনের ধোঁয়া মানুষের নিঃশ্বাসের সঙ্গে ঢুকে পড়ছে। বিশেষ করে কালো ধোঁয়া, অনেক রকম কেমিক্যাল ফুসফুসে প্রবেশ এর কারণে প্রচুর মানুষ এই ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছেন। এছাড়া পেশাগত কারণে ক্যান্সার সৃষ্টিকারী রাসায়নিক যেমন আর্সেনিক, নিকাল, সিলিকা ইত্যাদির সংস্পর্শে আসাও এই ক্যান্সারের কারণ হিসেবে উল্লেখ করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ফুসফুসের ক্যান্সারের লক্ষণ বা উপসর্গঃ

প্রাথমিক পর্যায়ে কোন নির্দিষ্ট উপসর্গ দেখা দেয় না বলেই জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। রোগটি দানা বাধার পর যে উপসর্গগুলো বেশি দেখা দেয় সেগুলো হলো,
গ্লোবাল হেপেন খবর পেতে ফলো করুন আমাদের গুগল নিউজ চ্যানেল
১. ক্রমাগত কাশি,
২.কাশির সঙ্গে রক্ত যাওয়া।
৩. শ্বাসকষ্ট ও বুকে ব্যথা,
৪. শরীরের ওজন হ্রাস পাওয়া,
৫.কণ্ঠস্বর বসে যাওয়া ইত্যাদি।
দীর্ঘদিন একটানা কাশি বা ক্রমাগত কাশিঃ
ফুসফুসের ক্যান্সারের প্রথম ও প্রধান উপসর্গ হলো,, কাশি। সাধারণত একটানা দীর্ঘদিন কাশি থাকলে তা ফুসফুসের ক্যান্সারের পূর্ব লক্ষণ হিসেবে মনে করা হয়। রোগীর যদি নির্দিষ্ট কোন কারণ ছাড়া একটানা দীর্ঘদিন কাশি থাকে এবং তিনি যদি ধূমপায়ী হয়ে থাকেন তাহলে এই ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি তার সবচেয়ে বেশি।
কাশির সঙ্গে রক্ত যাওয়াঃ
অনেক সময়ই কাশির সঙ্গে রক্ত যেতে পারে। কফের রং যদি মরিচা বা লালাভ হয়, তাহলে এটিও ফুসফুসের ক্যান্সারের প্রাথমিক লক্ষণ।
বুকে ব্যথা বা শ্বাসকষৃটঃ
ফুসফুসের ক্যান্সারের একটি সাধারণ উপসর্গ হলো, বুকে ব্যথা হওয়া। অবসাদ, রক্তশূন্যতা, স্ট্রেসসহ নানা কারণে বুকে ব্যথা করতে পারে। নিঃশ্বাস গ্রহণের সময় যদি তীব্র ব্যথা হয়, অথবা হাঁচি বা কাশি দেওয়ার সময় বুকে ব্যথা হতে পারে। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে কাজ করতে গেলে শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা দেখা দিতে পারে। আপনি যদি এই ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। এছাড়া আপনার যদি ব্যাকটেরিয়া জনিত কাশি, ঠান্ডা,, ব্রংকাইটিস, নিউমোনিয়া হয় এবং ওষুধ খাওয়ার পরও ভালো না হয়, তাহলে সেটাও ফুসফুসের ক্যান্সারের প্রাথমিক লক্ষণ হতে পারে।
কারণ ক্যান্সার শ্বাস গ্রহণ প্রক্রিয়া কে দুর্বল করে দেয়, যার ফলে এই ধরনের সংক্রমণ হতে পারে। হঠাৎ শরীরের ওজন কমতে শুরু করাও এই ক্যান্সারে আক্রান্ত হবার অন্যতম একটি লক্ষণ। এছাড়াও এই ক্যান্সার যদি ছড়িয়ে পড়ে তাহলে হাড়ে ব্যথা হবে। বিশেষ করে পিঠে বা পশ্চাদ অংশে ব্যথা ছড়িয়ে পড়ে। অনেকের নার্ভারস সিস্টেমে পরিবর্তন আসে। মাথায় ছড়িয়ে পড়ার কারণে প্রচন্ড মাথা ব্যথা, বমি ভাব হয়। ক্যান্সার যখন লিভাবে ছড়িয়ে পড়ে, তখন চোখের চামড়া ও রং পরিবর্তন হয়। আর এইসব লক্ষণ বা উপসর্গ দেখা দিলে খুব দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।
ফুসফুসের ক্যান্সার নির্ণয় ও চিকিৎসা পদ্ধতিঃ
চিকিৎসকরা বলছেন, নিয়মিত স্ক্রিনিং ফুসফুসের ক্যান্সার নির্ণয় ও চিকিৎসায় কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। রোগটি কোন পর্যায়ে আছে সেটার ওপর নির্ভর করে চিকিৎসা করানো হয়। সাধারনত যেসব পরিক্ষা প্রথমে করানো হয় সেগুলো হলোঃ
১.বুকের এক্সরে,
২. সিটি স্ক্যান,
৩.এমআরআই স্ক্যান,
৪. পেট স্ক্যান,
৫. বোন স্ক্যান,
৬.বায়োসপি,
৭. ব্রংকোস্কপি।
ফুসফুসের ক্যান্সারের ধরন ও ক্যান্সার কোন পর্যায়ে আছে, তার ওপর নির্ভর করে চিকিৎসা দেন চিকিৎসকরা। ফুসফুসের ক্যান্সারের ঝুঁকি এড়াতে সবার আগে চিকিৎসকেরা যে পরামর্শ দেন সেটা হল, ধূমপান ছেড়ে দিতে হবে। পরোক্ষ ধূমপানের কাছ থেকেও রক্ষা পাবেন অন্যেরাও। এছাড়া বায়ু দূষণ, পরিবেশ দূষণ কমাতে ও বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নেবার কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা। ফুসফুসের কার্যক্ষমতা বাড়াতে স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ করতে হবে। নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই রোগে যারা আক্রান্ত হচ্ছেন তাদের অনেকের মধ্যেই রোগটি ধরা পড়ছে মাঝামাঝি বা শেষ পর্যায়ে। সে কারণে রোগটির ঝুঁকিতে যারা আছেন, তাদের নিয়মিত পরীক্ষা-নিরীক্ষার ওপর জোর দিয়েছেন চিকিৎসকরা।