তেল খাওয়ার উপকারী ও ক্ষতিকর: ভোজ্য তেল কম খাবেন নাকি বেশি? এ নিয়ে হয়তো বিতরকের শেষ নেই। তবে পুষ্টিবিদের মনে করেন যে, গর্ভবতী মা, বুকের দুধ খাওয়ানো মা, বাড়ন্ত শিশু এবং কিশোর কিশোরীদের জন্য খাবার তেল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পুষ্টি চাহিদা পূরণে যেমন পর্যাপ্ত তেল দরকার, তেমনি যারা স্থূলতা, ডায়াবেটিস , হৃদরোগ কিংবা রক্তচাপের মতো সমস্যায় ভুগছেন তাদের কে আবার চিকিৎসকের পরামর্শে মেপে মেপে তেল খেতে হবে।
কার জন্য কতোটা তেল খাওয়া
পুষ্টিবিদ চৌধুরী তাসনীম হাসিনের মতে, নিজের স্বাস্থ্য পরিস্থিতি বুঝে, পরিমিত পরিমাণে তেল খাওয়া বেশি জরুরি। সে ক্ষেত্রে চাহিদা যদি বেশি বা কম থাকে তাহলে তেল খাওয়ার পরিমাণও কম বেশি হবে। এ নিয়ে একটি হিসাবও দিয়েছেন চৌধুরী তাস্নিম হাসিন। তাঁর মতে, এক থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের জন্য দৈনিক 3 থেকে 4 চা চামচ, 6 থেকে 12 বছর বয়সী শিশুদের জন্য সাত থেকে আট চা চামচ, এবং 40 বছর বয়স পর্যন্ত দৈনিক 6 থেকে 8 চা-চামচ তেল খাওয়া যেতে পারে। এরপর 40 বছরের উর্ধ্বে যাদের বয়স তাদের ক্ষেত্রে তেল গ্রহণের পরিমাণ, তার ওজন বুঝে কিছুটা কমিয়ে আনতে হবে। কারণ দৈনিক চাহিদার তুলনায় বেশি তেল খাওয়া স্বাস্থ্য ঝুঁকি থাকে।
কোন তেল ভালো, কোনটা ক্ষতিকরঃ

তেল,চর্বি মানেই যে খারাপ ব্যাপারটি তেমন না। নির্ভর করছে কি ধরনের তেল খাওয়া এবং সেটা কি পরিমানে? আমরা যে তেল চর্বি খেয়ে থাকি, এর মধ্যে কিছু তেল সেচুরেটেড এবং কিছু পলিআনস্যাচুরেটেড। সে হিসেবে খাওয়ার তেল দু রকমের হয়ে থাকে।
গ্লোবাল হেপেন খবর পেতে ফলো করুন আমাদের গুগল নিউজ চ্যানেল
১.এনিম্যাল ফ্যাট বা প্রাণিজ তেল। যে তেল চর্বি প্রাণী থেকে আসে। যেমনঃ গরু, খাসির চর্বির, ঘি, মাখন, ডালডা, ইত্যাদি প্রাণীজ ফ্যাট। এগুলোকে সেচুরেটেড ফ্যাট ও বলা হয়।
২. ভেজিটেবল অয়েল বা উদ্ভিজ্জ তেলঃ গাছ, ফুল বা শস্য থেকে যে তেল আসে সেটা উদ্ভিজ্জ তেল।একে পলি আনসেচ্যুরেডেট ফ্যাটও বলা হয়।যেমন সয়াবিন তেল, সরিষার তেল, কেনোলা তেল, জলপাইর তেল,সূর্যমুখীর তেল, ভূট্টার তেল ইত্যাদি।
তেল খাওয়ার উপকারিতাঃ
খাবারের তেলে রয়েছে, মানব দেহের জন্য প্রয়োজনীয় ক্যালরি, ফ্যাটি এসিড, ভিটামিন সি ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। যা শরীরের নানা ধরনের পুষ্টি স্বল্পতা পূরণ করে থাকে।
ক্যালরিঃ
আমরা প্রতিদিন যা খাই তার মধ্যে তেল থেকে সবচেয়ে উচ্চ হারে ক্যালোরি পাওয়া যায় বলে জানিয়েছেন পুষ্টিবিদ চৌধুরী তাস্নিম হাসিন। আর এটাই মানবদেহে শক্তি যোগায় বলে তিনি মনে করেন।
ভালো কোলেস্টরলঃ
ভালো তেল খাওয়া রক্তের এইচডিএল অর্থাৎ শরীরের জন্য উপকারী ভালো কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়ায়। কারো শরীরে আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট বা খারাপ কোলেস্টেরল এলডিএল বেশি থাকলে, সেটা নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে উদ্ভিজ্জ তেল।এটা হূদরোগ এবং রক্তচাপে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা কমিয়ে দেয়। আর লিভার সচল রাখে।
ফ্যাটি এসিডঃ
উদ্ভিজ্জ তেলে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ফ্যাটি এসিড। যা ক্যান্সার প্রতিরোধে সাহায্য করে, ত্বক ভালো রাখে, শরীরে বয়সের ছাপ দেরীতে পড়ে এবং চর্মরোগ দূর করে। যে তেল খাওয়া ওমেগা থ্রি ফ্যাটি এসিডের মাত্রা যত বেশি, সে তেলকে ততো ভালো হিসেবে মনে করেন পুষ্টিবিদরা।
ভিটামিন শোষণঃ
শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় ভিটামিন এ’, ডি, কে এবং ই’ ক্যাপসুল। অর্থাৎ এ ভিটামিন গুলো লিবারে শোষণ হতে হলে তেলের প্রয়োজন। এজন্য বলা হয় শাকসবজি বা অন্যান্য খাবারের প্রয়োজনীয় পুষ্টি গুণ পেতে হলে অবশ্যই সেগুলো তেল দিয়ে রান্না করতে হবে।
অ্যান্টি অক্সিডেন্টঃ
তেলে থাকা ভিটামিন-এ এন্টি অক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে থাকে, যা ত্বক, হাড়,, দাঁত এবং চোখের জন্যও বেশ উপকারী।
প্রোটিনঃ
তেলের প্রোটিন মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করে। হরমোনের ভারসাম্য রক্ষা করতেও তেলের প্রয়োজন।
তেল খাওয়ার ক্ষতিকর দিকঃ
প্রাণিজ তেলে থাকা সেচুরেটেড ফ্যাট খুব সহজে রক্তে এলডিএল বা খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। এই চর্বি সহজে শরীর থেকে বের হতে পারে না, ফলে হূদরোগ, রক্তচাপ, ডায়াবেটিস এবং স্থূলতার ঝুঁকি বাড়ে।
ট্রান্স ফ্যাটঃ
কেউ উদ্ভিজ্জ তেলে বা ডুবো তেলে ভেজে কিছু খান কিংবা একই তেল বারবার ব্যবহার করেন, তাহলে সেই ভেজিটেবল তেল ভেঙ্গে ট্রান্স ফ্যাটে রুপ নেয়, যা শরীরের জন্য বেশ ক্ষতিকর।
কায়িক শ্রমঃ
যারা শহরের বাসিন্দা, কায়িক পরিশ্রম কম করেন, স্থূলতায় ভুগছেন, তাদের ক্ষেত্রে তেলের প্রভাব ক্ষতিকর হতে পারে। যারা স্থূলতার, হূদরোগ,, রক্তচাপে ভুগছেন তাদের জন্য যেকোনো ধরনের তেলের পরিমাণ কমিয়ে আনতে হবে।
বৃটেনের জাতীয় স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের ক্ষেত্রে 30 গ্রাম এবং প্রাপ্ত বয়স্ক নারীদের 20 গ্রামের বেশি সেচ্যুরেটেড ফ্যাট খাওয়া ঠিক নয়। শিশুদের ক্ষেত্রে এই হার আরো কম।
তেল খেতে সতর্কতাঃ
তেল এর ক্ষেত্রে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, তেলের স্মোক পয়েন্ট অর্থাৎ যে তাপমাত্রায় তেল পুড়ে ফ্যাট গুলো ভেঙে যায়, তা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। তাই কতক্ষণ ধরে রান্না হচ্ছে সেটা বেশ জরুরী। যেমন আজকাল অনেকেই স্বাস্থ্যসচেতনতায় অলিভ অয়েল বা জলপাই তেল খাচ্ছেন। কিন্তু অনেক অলিভওয়েলের স্মোক পয়েন্ট অনেক কম হওয়ায় ভাজা পোড়ার ক্ষেত্রে এ তেল উল্টো ফল দিতে পারে। অলিভ অয়েল দিয়ে 17 মিনিটের বেশি সময় ধরে রান্না করা ঠিক নয় বলে মনে করেন পুষ্টিবিদ তাস্নিম হাসিন।
কারণ বেশি তাপে জলপাই তেলের কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যায়। তাই অলিভ অয়েল খেতে হলে সেটা খাবারে সরাসরি মিশিয়ে খেতে হবে। যেমন সালাদের, ড্রেসিংয়ের কিংবা খাবার অল্প আঁচে দ্রুত রান্না করে ফেলতে হবে। সয়াবিন তেল বাজারে প্রচলিত অন্যান্য তেল রান্নার সময় সহজে ভেঙে যায় না। পোড়া তেল শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। কারণ বারবার তেল পুড়লে নতুন বিক্রিয়ায় রাসায়নিক গঠন পরিবর্তিত হয়ে ইউরিক অ্যাসিড সহ বহু বিষাক্ত উপাদান তৈরী হয়। এতে হার্টের ক্ষতি হতে পারে। তাই পুষ্টিবিদরা বলছেন, পরিমিত তেলে ভাজা খাবার খেতে হবে। অনেকটা অনেকক্ষণ ধরে রান্না করা এড়িয়ে যেতে হবে।
বৃটেনের ডিমনর্ফোট বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ ফার্মেসি এক গবেষণা চালিয়ে দেখেছে যে, উচ্চ তাপমাত্রায় রান্না করলে তেল চর্বিতে থাকা উনরঘঠন বদলে যায়। বাতাসে অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া করে বা অক্সিডেশন হয়। সেখান থেকে উৎপন্ন হয় অ্যালডিহাইড এবং লিপিড পারঅক্সাইড। অ্যালডিহাইড নিশ্বাস বা খাবারের সাথে অল্প পরিমাণে গ্রহণ করলেও সেটা হূদরোগ এবং ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। এক্ষেত্রে গবেষকরা পরামর্শ দিয়েছেন, সম্ভব হলে টিস্যু বা শোষক কাগজ দিয়ে ভালোভাবে ভাজা খাবার এর তেল ছেঁকে খেতে হবে। তরকারির উপরে তেলের আস্তর তুলে ফেলে দেয়া যেতে পারে। পুষ্টিবিদদের মতে, কোন তেল খাচ্ছেন সেটা জরুরি হলো কতটুকু খাচ্ছেন কীভাবে খাচ্ছেন।