বাইপোলার ডিসঅর্ডার: এমন কিছু মানুষ আছেন, যারা একসময় ভীষণ মানসিক ভাবে উৎফুল্ল থাকেন। আবার কদিন পরে হতাশায় ডুবে যান। ২ টি অনুভূতির তীব্রতা অনেক বেশি থাকে যারা এধরনের চরম মেজাজ পরিবর্তনে ভুগছেন, তাদের জানা জরুরী এটি বাইপোলার ডিসঅর্ডার এর প্রভাবে হচ্ছে কিনা। বাইপোলার ডিসঅর্ডার এমন এক ধরনের তীব্র মানসিক স্বাস্থ্য পরিস্থিতি, যা আপনার মুড বা মেজাজকে প্রভাবিত করে। এটি ম্যানকটি ডিপ্রেশন নামেও পরিচিত। আপনার বা আপনার কাছের কারো বাইপোলার ডিসঅর্ডার আছে কিনা? কিভাবে বুঝবেন? এর লক্ষন গুলো কি? সমস্যা থাকলে কিভাবে বেরিয়ে আসা যায়? এই কনটেন্টে দেয়া তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে বৃটেনের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ এবং আমেরিকান সাইক্রেটিক অ্যাসোসিয়েশন থেকে।
বাইপোলার ডিসঅর্ডার কি?
আপনি যদি হঠাৎ খুব খুশি অনুভব করেন, অতিরিক্ত একটিভ হয়ে যান, মন অস্থির থাকে এবং তারপর হঠাৎ আপনার এনার্জি অনেক কমে যায় প্রচন্ড বিষণ্ণ বোধ করেন তাহলে আপনার বাইপোলার ডিজঅর্ডার থাকতে পারে। মেজাজের এই চরম উত্থান-পতনের অনুভূতি কয়েকদিন এমনকি কয়েক মাস পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। এ একেক ধরনের মেজাজের সময়কাল কে মুট এপিসোড বলা হয়। মন চরম উৎপুল্ল বা অতিরিক্ত একটিভ থাকার এপিসোড কে বলা হয়। বিষন্ন অবস্থাকে বলা হয় ডিপ্রেশন। বাইপোলার ডিসঅর্ডার আক্রান্তরা কিছু সময় স্বাভাবিক ও থাকতে পারেন। আক্রান্তদের অনুভূতিগুলো এত তীব্র থাকে, এতে তাদের প্রতিদিনের রুটিন, সামাজিক যোগাযোগ, প্রিয়জনের সাথে সম্পর্ক, অফিস, পড়াশোনা বা যেকোনো কাজের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। এতে আত্মহত্যার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
লক্ষণঃ
বাইপোলার ডিসঅর্ডার এর লক্ষণ গুলো নির্ভর করে আপনি কোন এপিসোডে আছেন তার ওপরে। অনেকে প্রথমদিকে ডিপ্রেশন এপিষদে থাকতে পারেন, তারপর আসতে পারে মেনি এপিসোড। এ এপিসোড এর পরিবর্তন যখন তখন হতে পারে। আবার অনেকের দুটো এপিসোড একসাথে দেখা দিতে পারে। তবে আগেই জানিয়ে রাখি এসব লক্ষ্য থাকা মানেই যে আপনি বাইপোলার ডিজঅর্ডার এ ভুগছেন সেটা বলা যাবে না। এটা শুধুমাত্র একজন মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলতে পারবেন।
ডিপ্রেশনঃ
ম্যানিক পর্বের আগে আপনার ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশন বা বিষন্নতা এপিসোড দেখা দিতে পারে। এ এপিসোডে নিজেকে একদম মূল্যহীন মনে হতে পারে। যার প্রভাবে অনেকে আত্মহত্যার চিন্তা ও করেন। এ এপিসোডের সাধারণ লক্ষণগুলো হলোঃ চরম দুঃখবোধ ও আশাহীন লাগে, বা মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়, এনার্জীর অভাব, মনোযোগ দিতে এবং মনে রাখতে সমস্যা হয়, প্রতিদিন সাধারণ কাজ কর্ম করতে ইচ্ছা করে না, যেমন দাঁত ব্রাশ করা, চুল আঁচড়ানো, বিছানা ঠিক করা, বিষণ্ণ বোধ হয় নিজেকে মূল্যহীন লাগে, নিজের দক্ষতা নিয়ে সন্দেহ থাকে, অপরাধবোধ এবং হতাশা ভর করে, আত্মহত্যার চিন্তা ঘুরপাক খায়। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন বাইপোলার ডিসঅর্ডার আক্রান্তদের আত্মহত্যার ঝুঁকি সাধারণ মানুষের তুলনায় 15 থেকে 20 গুণ বেশি থাকে এবং অর্ধেকের বেশি মানুষ অন্তত একবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেন।
ম্যানিয়াঃ
ম্যানওয়া পর্যায়ে আপনি খুব উৎসাচ্ছি,অনেক আনন্দে থাকপন।আত্মবিশ্বাস অনেক বেড়ে যায়, প্রচুর এনাজি পান, বড় বড় পরিকল্পনা করেন। কিন্তু এ ভালো বোধের তীব্রতা এতটাই বেশি যে, অনেক সময় ব্যক্তি তার সাধ্যের বাইরে কেনাকাটা করেন, প্রচুর খরচ করেন, যেটা হয়তো স্বাভাবিক সময়ে তিনি ভাবতেও পারে না। এসময় তারা দ্রুত কথা বলেন, খেতে বা ঘুমাতে ভালো লাগে না, অল্পতেই বিরক্ত হয়ে যান। অনেকে আবার সাইকোসিসের লক্ষণ দেখা দেয়। যেমন আপনি এমন কিছু দেখতে বা শুনতে পান যা বাস্তবে নেই।
ম্যানিয়ার লক্ষণগুলো হলো খুবই উচ্ছ্বসিত আত্মবিশ্বাসী অস্থির বোধ করা, এনার্জি বেড়ে যায়, উচ্চাভিলাষী ও সৃজনশীল পরিকল্পনা করেন , অপ্রয়োজনে প্রচুর অর্থ ব্যয়, খেতে বা ঘুমাতে ভালো লাগে না, খুব দ্রুত কথা বলা সহজে বিরক্তও উত্তেজিত হয়ে যাওয়া, নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা, সহজেই বিভ্রান্ত হওয়া, অযৌক্তিক চিন্তাভাবনা করা। কারো মধ্যে যূি ২ টি এপিসোড এক সাথে কাজ করে, তাহলে তারা একদিকে যেমন বিষন্ন থাকেন, অন্যদিকে কাজে ভীষণ একটিভ থাকতে দেখা যায়। সাধারণত ম্যানিয়ার এপিসোড এর চাইতে বিষন্নতার এপিসোড বেশি সময় ধরে থাকে। যেমন মেনিয়া যদি তিন থেকে ছয় মাস থাকে, তাহলে বিষণ্নতা থাকতে পারে ছয় থেকে বারো মাস।
বাইপোলার ডিসঅর্ডার হওয়ার কারণ কি?
বাইপোলার ডিসঅর্ডার হওয়ার সঠিক কারণ এখনো জানা যায়নি। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনেক শারীরিক ও মানসিক চাপের মধ্যে থাকলে, যেমন কর্ম ক্ষেত্রে নানা ধরনের চাপ, সম্পর্কে টানাপোড়েন, সর্ম্পকে ভাঙ্গন, সেইসাথে ব্যক্তি বা সামাজিক জীবনে অনেক সমস্যার মধ্যে দিয়ে গেলে , যেমন অনেক অভাব, শারীরিক যৌন বা মানসিক নির্যাতন, সেইসাথে জীবনে মোড় ঘোড়ানো পরিবর্তন এলে, যেমন পরিবারের ঘনিষ্ঠ সদস্য বা প্রিয় জনের মৃত্যুর কারণে বাইপোলার ডিসঅর্ডার আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়।
অনিয়মিত জীবনযাপন যেমন খাওয়া-দাওয়া নিয়ন্ত্রণ না থাকায়, অপর্যাপ্ত ঘুম, মদ ও ধূমপানের অভ্যাস ইত্যাদি বাইপোলার ডিজঅর্ডার হওয়ার আশঙ্কা বাড়িয়ে দেয়। সেই সাথে মস্তিষ্কের বিভিন্ন কেমিক্যাল বা রাসায়নিক মস্তিষ্কের কাজ নিয়ন্ত্রণ করে সেগুলো হলো ডোপামিন। যাদের নিউরোট্রান্সমিটার বলা হয়। যদি এক বা একাধিক কেমিক্যাল নিউরোট্রান্সমিটারের মাত্রায় ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়, তবে একজন ব্যক্তি বাইপোলার ডিসঅর্ডার এ আক্রান্ত বলে ধরা যেতে পারে।
এছাড়া অন্যান্য মানসিক ব্যাধি থাকলে, যেমন মনোযোগে ঘাটতি, অতিরিক্ত উদ্বেগ, হাইপেরাক্টিভিটি ডিটিএইচ থাকলেও তাদের বাইপোলার ডিসঅর্ডার আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। গবেষণা অনুযায়ী প্রতি 100 জনের মধ্যে একজন তাদের জীবনের কোনো না কোনো সময়ে বাইপোলার ডিসঅর্ডার এর আক্রান্ত হয়েছেন। বাইপেলার ডিসঅর্ডার যে কোন বয়সে হতে পারে। এর মধ্যে 15 থেকে 25 বছর বয়সের মধ্যে দেখা দেয়ার আশঙ্কা বেশি। তবে চল্লিশের পর এতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি তুলনামূলক কম। সেইসাথে পুরুষ এবং নারীদের বাইপোলার ডিসঅর্ডার আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও সমান।
চিকিৎসাঃ
আপনার বাইপোলার ডিসঅর্ডার আছে কিনা তা একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ভাল বলতে পারবেন। এজন্য তারা আপনাকে বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন করবেন। যেমন আপনার মানসিক এপিসোড গুলো কতটা তীব্র হয়, আত্মহত্যার চিন্তা আসে কিনা, পরিবারে কারো এমন সমস্যা আছে কিনা, এরপর বিভিন্ন স্বাস্থ্য পরীক্ষা দিতে পারেন। আপনার সার্বিক পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে তারা সিদ্ধান্ত নেবেন আপনার কোন চিকিৎসা প্রয়োজন। তবে চিকিৎসকরা জানান, আপনার বাইপোলার ডিসঅর্ডার আছে। তাহলে আপনার উচিত হবে তার পরামর্শ মতো নিয়মিত চিকিৎসা নেয়া। এতে একজন ব্যক্তি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন।
চিকিৎসকরা ম্যানিয়া এবং ডিপ্রেশান এপিসোড গুলো প্রতিরোধ করতে মেজাজ শিথিল করার ওষুধ দিতে পারেন।যা দীর্ঘমেয়াদে প্রতিদিন খেতে হয়। সেই সাথে কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি এবং পারিবারিক সম্পর্ক ভালো করার থেরাপির মাধ্যমে বিষন্নতা মোকাবেলা করতে বলা হয়। এসব থেরাপি 6 মাস থেকে বারো মাস ধরে নিতে হতে পারে। এছাড়া নিয়মিত ব্যায়াম করা, নিজের পছন্দের কাজ করা, সুষম খাবার খাওয়া, ওজন নিয়ন্ত্রণ এবং পর্যাপ্ত ঘুম বাইপোলার ডিসঅর্ডার এর লক্ষণ গুলো কমাতে সাহায্য করতে পারে। এজন্য চিকিৎসকরা একটি কঠিন রুটিন দিয়ে থাকে।
সেই সাথে কাজের অতিরিক্ত চাপ কমানো জরুরি আবার অনেকে এসব এপিসোডের কষ্ট কমানোর জন্য ধূমপান মাদক ইত্যাদি নিয়ে থাকেন। এতে পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়। এক কথায় ঔষধ, থেরাপি ও জীবনযাত্রার পরিবর্তন আনার মাধ্যমে এর চিকিৎসা চলে। সাধারণত লক্ষণগুলি গুরুতর না হলে অর্থাৎ নিজের বা অন্যের ক্ষতি করার আশঙ্কা না থাকলে হাসপাতালে থেকে চিকিৎসা নেয়ার প্রয়োজন হয়না। বাইপোলার ডিসঅর্ডার গর্ভাবস্থায় আরো খারাপ প্রভাব ফেলতে পারে। আবার গর্ভাবস্থায় এবং দুধ খাওয়ানো মায়েদের বাইপোলার ওষুধ গ্রহণের ঝুঁকিও থাকে এ ক্ষেত্রে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
চিকিৎসকের সাথে আলোচনা না করে ওষুধ বন্ধ বা ওষুধ চালিয়ে যাওয়ার কোনো সিদ্ধান্ত নেবেন না। আরেকটি বিষয় আপনি যদি বাইপোলার ডিসঅর্ডার আক্রান্ত হন, তাহলে বিষয়টি চেপে না রেখে পরিবার এবং বন্ধুদের সাথে কথা বলুন। তাদের সাহায্য নিন। কারন আপনার তাদের সাহায্য প্রয়োজন। এমন নানা ধরনের কনটেস্ট পেতে চোখ রাখুন আমাদের ওয়েবসাইটে।
ReplyForwardAdd reaction |