এই পোস্টটি পড়ে যতক্ষণে আপনি শেষ করবেন ততক্ষণে সারা বিশ্বে প্রায় 40 লক্ষ কাপ কফি পান করা হয়ে যাবে। কমপক্ষে দেড় হাজার বছর ধরে মানুষ কফি খেয়ে আসছেন এবং কেউ কেউ বলেন মানবসভ্যতা এর গুরুত্ব এত বেশি যে, কফি ছাড়া অনেক বড় বড় ধারণার জন্মই হতো না। যা আমাদের বিশ্বকে নতুনভাবে দেখতে আবিষ্কার করতে শিখিয়েছে।
কফির প্রধান সক্রিয় উপাদান হলো ক্যাফিন যাকে পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত সাইকোএক্টিভ মাদক হিসেবে ভাবা হয়।
কোথা থেকে আসে এই কফি ?

আর আমরা যখন করি তখন এটি আমাদের শরীরে কি করে। কপি আসে গাছের ফল থেকে। যা প্রথম ইথিওপিয়ার পাওয়া যায়।
এ নিয়ে এমন একটি গল্প শোনা যায় যে, নবম শতাব্দীতে তালদি নামের এক রাখাল দেখেন কপি বেরিয়েছে তার ছাগল গুলো আরো বেশি চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। তাই তখন তিনি একটু খেয়ে দেখেন। ঐতিহাসিক থেকে জানা যায় যে, ইয়েমেনের সুফিরা কফি ভেরি বিগ বাবে যে সেটি থেকে এক ধরনের পানীয় তৈরি করেন। যাকে আমরা এখন কফি নামে চিনি।
গ্লোবাল হেপেন খবর পেতে ফলো করুন আমাদের গুগল নিউজ চ্যানেল
পঞ্চদশ শতাব্দীতে অটোমান সাম্রাজ্য জুড়ে প্রথম কপি হাউজ গুলো চালু হতে দেখা যায় এবং পরবর্তী শতাব্দীতে এগুলো ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। ইউরোপের এক সময় কতগুলি ব্যবসা রাজনীতি এবং নতুন আইডিয়া বা ধারণা নিয়ে আলোচনার স্থান হয়ে ওঠে। এমনকি একজন শিক্ষাবিদ হ্যাবারমাস বলেছেন, কফি ছাড়া আমরা হয়তো সংস্কারমুক্ত হতে পারতাম না। এবং ভলতেয়ার এর মত দার্শনিকরা যারা দিনে মোটামুটি 72 কাপ কপি পান করতেন একটা সময় তারা বিশ্ব সম্পর্কে ক্যাথলিক চার্চের ব্যাখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছিলেন। পরবর্তীতে তারা এই চিন্তা নিয়ে বিজ্ঞানের দিকে মনোযোগ দেন যে মহাবিশ্বের সবকিছু যুক্তিযুক্তভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব।
এই তথাকথিত এইজ অফ এনলাইটমেন্ট বা চিন্তার বিকাশ এর যুগ পৃথিবীর প্রতি আমাদের ধারণা আমূল পরিবর্তন করেছে। এটি রাজতন্ত্রের অবসান গণতন্ত্রের বিকাশ এবং অসংখ্য বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের দিকে আমাদের পরিচালিত করেছিল।
কফি একটা সময় দাস ব্যবসার ইন্ধন যোগায়। ফরাসিরা আফ্রিকান ক্রীতদাসদের দিয়ে হেঁটে কপি বাগান করত এবং ১৮০০ দশকের গোড়ার দিকে আফ্রিকান দাসদের ব্যবহার করে ব্রাজিল বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ কফি উৎপাদন করত। কেউ কেউ আবার এই যুক্তি ও দেন যে কফি পুঁজিবাদের জন্ম দিতে সাহায্য করেছে। কিন্তু কপি কি আসলেই পুঁজিবাদের জন্ম দিয়েছে?
কোম্পানিগুলো একটা সময়ে কর্মীদের কপি দেয়া শুরু করে এবং এক সময় তাদের কফি পানের বিরতির নিতে দেয়। তবে এটি মালিকদের পক্ষ থেকে স্বার্থহীন কোন বিষয় ছিল না তারা আসলে শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর চেষ্টা করছিল। সে যুগ থেকে বর্তমান যুগে আসি এখন বিশ্বে মানুষ প্রতিদিন 200 কোটি কাপ কফি খাচ্ছে।
কফি বছরে 9 হাজার কোটি ডলারের একটি শিল্প গড়ে উঠেছে। শুধু তাই নয় কপি এখন কোটি কোটি মানুষের দৈনন্দিন জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এখন দেখা যাক কবে কীভাবে আমাদের শরীরে প্রভাব ফেলে?
যখন ক্যাফিন আপনার পরিপাকতন্ত্রের প্রবেশ করে, তখন এটি অঞ্চলের মাধ্যমে রক্তের প্রবাহ মিশে যায়। কিন্তু এর প্রভাব তখনই শুরু হয় যখন ক্যাফিন স্নায়ুতন্ত্রের প্রবেশ করে। এটি ঘটে কারণ ক্যাফিনের এমন একটি রাসায়নিক গঠন রয়েছে যার কাঠামো আমাদের নিজেদের শরীরের উৎপাদিত হয়। এমন একটি রাসায়নিক এর মত যার নাম ক্যাফিন। আমাদের শরীরকে অ্যাডিনোসিন রিসেপ্টর কে ঘিরে ফেলে যা স্নায়ু কোষের পৃষ্ঠে পাওয়া যায়।
অ্যাডিনোসিন এমন একটি উপাদান যা আমাদের সিমপ্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেম বা সমবেদী স্নায়ুতন্ত্র দুর্বল করে। এটি আপনার হৃৎস্পন্দন কমিয়ে দেয়, এতে ঘুম ঘুম ভাব হয় এবং শরীরে শিথিলতা তৈরি হয়।
এই রিসেপ্টর গুলোকে আচ্ছাদিত করে ক্যাফিন শরীরে এর ঠিক বিপরীত প্রভাব তৈরি করে যেমন যদি আপনার নিয়মিত কপি পানের অভ্যাস না থাকে তাহলে কফি পান করার পর আপনার রক্তচাপ কিছুটা বাড়তে পারে।
মস্তিষ্কের কার্যকলাপের ক্ষেত্রেও এটি কাজ করে ক্যাফিন মস্তিষ্ককে উদ্দীপিত করে ক্ষুধা কমিয়ে দেয় এবং আপনাকে সতর্ক অবস্থায় থাকতে সাহায্য করে। যাতে আপনি দীর্ঘ সময় মনোযোগ ধরে রাখতে।পারেন।
ক্যাফিন আপনার মন মেজাজের ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে আপনার ক্লান্তি দূর করতে পারে এবং শারীরিক কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করতে পারে। এ কারণে অনেকে সিলেট থেকে সাপ্লিমেন্ট হিসেবেও ব্যবহার করে এবং এর প্রভাব গুলো ১৫ মিনিট থেকে দুই ঘণ্টা পর্যন্ত থাকতে পারে। আমাদের শরীর কপি গ্রহণ করার ৫ থেকে ১০ ঘণ্টা পর ক্যাফিন শরীর থেকে বের করে দেয়।
তবে ক্যাফিনের প্রভাব আরো দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে আপনি যদি আপনার শরীরে কফির কার্যকারিতা বাড়াতে চান তবে বিকেলের পর কফি পান না করাই ভালো এতে পরেরদিন সকালে আপনি যখন কপি পান করবেন তা আপনার শরীরে আরো কার্যকারী প্রভাব ফেলবে। কপি পান করার সময় একটু যত্ন নিয়ে পান করতে হয়। একজন সুস্থ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ দিনে সর্বোচ্চ ৪০০ মিলিগ্রাম ক্যাফেইন গ্রহণ করতে পারেন। যা প্রায় ৪-৫ কাপ কফি সমান। এর বেশি পান করলে অনিদ্রা, নার্ভাসনেস, উদ্বেগ, হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়া পেটে অস্বস্তি বমি বমি ভাব এবং মাথা ব্যাথার মত পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হতে পারে।
যদি কেউ পর পর 12 কাপ কপি বা প্রায় ১২০০ মিলিগ্রাম ক্যাফেইন গ্রহণ করেন, তাহলে তার শরীরে এর বিষক্রিয়ার ফলে খিঁচুনির মতো প্রভাব দেখা দিতে পারে।
যদিও এই সীমা একেকজনের ক্ষেত্রে একেক রকম কিন্তু জিনগতভাবে কারো কারো শরীর গ্রাফিনের প্রতি একটু বেশি সংবেদনশীল। তবে পরিমিত মাত্রায় পান করতে পারলে, কপি শরীরের জন্য বেশ উপকারী।
যেমন হারবার TH .JAN স্কুল অফ পাবলিক হেলথের ডক্টর ম্যাচে সেনের মতে, কপি টাইপ টু ডায়াবেটিস, কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজ, কিছু ক্যান্সার এবং পারকিনসন রোগের ঝুঁকি হ্রাসের সাহায্য করে। এই স্বাস্থ্যগত উপকারিতা শুধুমাত্র ক্যাফিনের জন্যই হয় না। বরং কফিতে অন্যান্য আরো উপকারী উপাদান রয়েছে। যেমন ক্লোরোজনীক অ্যাসিড এটি একটি শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। যা অনেক রোগের ঝুঁকি কমাতে পারে।